কৃষ্ণকলি
– সঞ্চিতা রায়
কৃষ্ণকলি সেলাই স্কুলের আজ বাৎসরিক অনুষ্ঠান। সারা শহরে আজ কৃষ্ণকলির অনেক শাখা। এই স্কুলের কর্ণাধার কৃত্তিকা এখন শহরের যথেষ্ট পরিচিত নাম। শহরের অনেক ছেলেমেয়ে তার সাহায্যে আজ স্বাবলম্বী। বার্ষিক অনুষ্ঠানে সেলাই যেমন আছে, তেমনি নাচ গান কবিতা নানা অনুষ্ঠানের ও ব্যবস্থা আছে। সব মিলিয়ে এ এক বড় মিলন উৎসব। সমস্ত শাখার ছাত্ররছাত্রীরা মিলেই অনুষ্ঠানকে এগিয়ে নিয়ে যায় এরা। হাতের কাজের প্রদর্শনী ও বিক্রয়ের ব্যবস্থা আছে। চার দিন ধরে অনুষ্ঠান চলে। অনুষ্ঠান মানে আনন্দের বন্যা । সারা বছর ছাত্রছাত্রীরা এই সময়টার জন্য অপেক্ষা করে, ঠিক যেমন করে মানুষ দুর্গাপুজোর জন্য অপেক্ষা করে। কৃত্তিকা একটা চেয়ারে বসে বসে ছাত্রছাত্রীদের তৎপরতা দেখছে, অনাবিল এক আনন্দে তার মন ভরে যাচ্ছে। কৃষ্ণকলি সেলাই স্কুলের সাথে আরেকটি স্কুল যুক্ত আছে। শুভাঙ্কন স্কুল, শুভর অঙ্কন স্কুল। এই স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা অনেক ক্ষেত্রেই কৃষ্ণকলি স্কুলের সেলাই-এর কাজে ড্রইং এঁকে সাহায্য করে। শুভ আর কৃত্তিকার মধ্যে রয়েছে অপূর্ব এক বন্ধুত্ব। দু’জনে দু’জনকে নিঃস্বার্থ ভাবে সব কাজে সাহায্য করে। ছাত্রছাত্রীর কাজ দেখছে মুগ্ধ হয়ে কৃত্তিকা। বাড়িতে পরপর দুই ছেলের পর যখন কৃত্তিকা জন্মায়, বাড়ির লোক ভীষণ ভীষণ খুশি ছিল। খুশি ছিল দুই ভাই তাদের বোনকে পেয়ে। বড়দাদা দশ, ছোড়দাদা আট। অনেকটাই বড় তার চেয়ে। দাদাদের আদরের খুব। কিন্তু আত্মীয় স্বজনরা পাড়াপ্রতিবেশীরা এবার নতুন এক আলোচনা শুরু করলো। কৃত্তিকা তার দাদাদের মত ফর্সা নয়। “শোনো একটু বড় হলেই দুধের সর মাখানো শুরু কোরো কিন্তু, তাতে যদি রঙটা একটু খোলে”। “বিয়ে দিতে হবে মনে থাকে যেন”। কৃত্তিকার বাবা প্রতিবাদ করতো, “মেয়ে আমার নিজের পায়ে দাঁড়াবে, ওর রঙ নিয়ে আমি ভাবতে চাই না”। বড় হতে থাকে কৃত্তিকা । কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে গেলেই রঙ নিয়ে প্রশ্ন তোলে লোকজন। মনে মনে গুটিয়ে থাকে কৃত্তিকা।
পড়াশোনায় যথেষ্ট ভাল সে। মাধ্যমিকে স্টার পায়। কিন্তু আত্মীয় পড়শীরা বিরক্ত করতে থাকে। “এখন থেকেই সম্বন্ধ দেখতে থাকো, পরে কিন্তু বিপদে পরবে”। বাবা মা যথেষ্ট প্রগতিশীল হয়েও সমাজ দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকে। পাত্র পক্ষরা আসে, মিষ্টি খায় রঙ নিয়ে কটাক্ষ করে চলে যায়। উচ্চ মাধ্যমিকের পর ফাইন আর্টস-এ অনার্স নেয় সে। পাত্র পক্ষ আসে, অনেক মোটা অঙ্কের টাকা দাবী করে। মেয়ের প্রতি কটাক্ষ সহ্য হচ্ছিল না বাবা মায়ের। তারা অনেক টাকার বিনিময়ে মেয়েকে পাত্রস্থ করতে রাজি হয়ে যান। সব শুনে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে কৃত্তিকা। “এ বিয়ে আমি করবো না বাবা”। বড়বৌদি তাকে সমর্থন করলেও ছোটবৌদি বলেন, “তবে কি সারাজীবন এই বাড়িতেই থাকবে?এরপর আর কেউ যদি তোমায় বিয়ে করতে না চায়”! “শোনো বৌদি এই বাড়িতে দাদাদের বা তোমাদের যতটা অধিকার আছে, আমার ঠিক ততটাই আছে, বাড়িটা আমার বাবার। বাবার সাথে আমার কথা হয়েছে, যে টাকা বাবা আমার বিয়েতে দিতে চেয়েছিলেন, তার থেকে কিছুটা নিয়ে আমি ব্যবসা শুরু করবো। পরে প্রতিষ্ঠিত হলে ওই টাকা বাবার হয়েই গরীব মানুষকে দান করবো, আমার জীবনের সিদ্ধান্ত এখন থেকে আমিই নেবো।” স্নাতক হওয়ার পর সেলাইয়ে লেডি ব্রাবোর্ণ-এ ডিপ্লোমা করলো সে। বাড়ির একটা ঘর নিয়ে মাত্র দু’জন ছাত্রীকে নিয়ে তার পথ চলা শুরু। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। দুঃস্থদের জন্যেও প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে কৃষ্ণকলি সংস্থা। সাথে রয়েছে শুভাঙ্কনের শুভ ও তার ছাত্রছাত্রীরা। মাঝে মাঝে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে শুভ ও কৃত্তিকা একসঙ্গে বেড়াতে যায়।
মাঝে মধ্যে শুভ ও কৃত্তিকা একই ট্রাভেলিং এজেন্সির সাথে নিজেরাও ঘুরতে যায়। শান্তিনিকেতন ওদের প্রিয় জায়গা। কোপাই এর তীর, বাউল গান, ছাতিম তলা বড় মনকে ভাল করে দেয় তাদের। হোটেলে তাদের ঘর আলাদা থাকে। তবে তারা ঘুরে বেড়ায় একসাথে। সমাজে এই নিয়েও নানা কথা ওঠে। ছোটবৌদি ডেকে বলে “তোমার জন্য আমাদের সম্মান নষ্ট হচ্ছে,সেরকম হলে বিয়ে করে নাও না তোমরা”। “আমরা খুব ভাল বন্ধু। বন্ধুত্বের কোনো লিঙ্গভেদ হয় না। আপাতত আমরা বন্ধু হিসাবেই পরস্পরের পাশে থাকবো, তবে পরে বিয়ে করবো, না লিভ টুগেদারে থাকবো, না এই রকম বন্ধু হিসেবেই কাটাবো সেটা আমরাই ঠিক করবো, সমাজ নয়। জীবনটা আমাদের তাই সিদ্ধান্তটা আমরাই নেবো। ভাইঝিরা দু’জন এসে পিসিকে পূর্ণ সমর্থন জানায়। “হ্যাঁ পিসি জীবন তোমার সিদ্ধান্ত ও একান্ত তোমার হোক আমরা পাশে আছি ও থাকবো।
হ্যাঁ এখনও সুন্দর বন্ধুত্বের বাঁধনে থেকে তারা কাজ করে চলেছে। কৃত্তিকা বাবা মায়ের যত্ন স্কুল চালানো সবেতেই সফল আজ। সমাজকে উপযুক্ত জবাব সে তার কাজ দিয়েই দিয়ে দিয়েছে।